মানুষ কবিতা

মানুষ কবিতা

কাজী নজরুল ইসলামের মানুষ কবিতা টি অসাধারন একটি কবিতা। কাজী নজরুল ইসলামকে বিদ্রোহী কবি বলা হতো।তিনি সকল সময়ই মানুষের অধিকার নিয়ে বিদ্রোহ করে গিয়েছেন। আর সেই ধারনার তাগিদেই তিনি তার মানুষ কবিতা টি লিখেছেন।মানুষ কবিতার কিছু দিক নিয়ে আজকে আলোচনা করা হবে। 



মানুষ 


কাজী নজরুল ইসলাম 



গাহি সাম্যের গান-

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!

নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,

সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।-

                  পূজারী, দুয়ার খোলো,

ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হলো!’

স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়,

দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হ’য়ে যাবে নিশ্চয়!-

জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কন্ঠ ক্ষীণ

ডাকিল পান্থ, ‘দ্বার খোলো বাবা, খাইনিকো সাত দিন!’

সহসা বন্ধ হলো মন্দির, ভুখারী ফিরিয়া চলে,

তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে!

                  ভুখারি ফুকারি কয়,

ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!’


মসজিদে কাল শিরনি আছিল, অঢেল গোস্ত-রুটি

বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটিকুটি!

এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে আজারির চিন,

বলে ‘বাবা, আমি ভুকা-ফাঁকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন!’

তেরিয়া হইয়া হাঁকিল মোল্লা – ‘ভ্যালা হলো দেখি লেঠা,

ভুখা আছো মরো গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নামাজ পড়িস বেটা?’

ভুখারী কহিল, ‘না বাবা!’ মোল্লা হাঁকিল – ‘তা হলে শালা,

সোজা পথ দেখ!’ গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা!


ভুখারি ফিরিয়া চলে,

                  চলিতে চলিতে বলে-

‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,

আমার ক্ষুধার অন্ন তা’বলে বন্ধ করনি প্রভু!

তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,

মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!’

কোথা চেঙ্গিস, গজনি-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?

ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার!

খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?

সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি-শাবল চালা!


                  হায় রে ভজনালয়,

তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়!

                  মানুষেরে ঘৃণা করি

ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি

ও মুখ হইতে কেতাব-গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে,

যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,

পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল! -মূর্খরা সব শোনো,

মানুষ এনেছে গ্রন্থ; -গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।

আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মাদ

কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর, -বিশ্বের সম্পদ,

আমাদেরি এঁরা পিতা-পিতামহ, এই আমাদের মাঝে

তাঁদেরি রক্ত কম-বেশি করে প্রতি ধমনীতে রাজে!

আমরা তাঁদেরি সন্তান, জ্ঞাতি, তাঁদেরি মতন দেহ,

কে জানে কখন মোরাও অমনি হয়ে যেতে পারি কেহ।

হেসো না বন্ধু! আমার আমি সে কত অতল অসীম,

আমিই কি জানি কে জানে কে আছে আমাতে মহামহিম।

হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি, তোমাতে মেহেদী ঈসা,

কে জানে কাহার অন্ত ও আদি, কে পায় কাহার দিশা?

কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি?

হয়ত উহারই বুকে ভগবান্‌ জাগিছেন দিবারাতি!

অথবা হয়ত কিছুই নহে সে, মহান উচ্চ নহে,

আছে ক্লেদাক্ত ক্ষত-বিক্ষত পড়িয়া দুঃখ-দহে,

তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন্থ ভজনালয়

ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়!

হয়তো ইহারি ঔরসে ভাই ইহারই কুটির-বাসে

জন্মিছে কেহ- জোড়া নাই যার জগতের ইতিহাসে!

যে বাণী আজিও শোনেনি জগৎ, যে মহাশক্তিধরে

আজিও বিশ্ব দেখনি,-হয়ত আসিছে সে এরই ঘরে!


ও কে? চন্ডাল? চম্‌কাও কেন? নহে ও ঘৃণ্য জীব!

ওই হতে পারে হরিশচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব।

আজ চন্ডাল, কাল হ’তে পারে মহাযোগী-সম্রাট,

তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে, করিবে নান্দীপাঠ।

রাখাল বলিয়া কারে করো হেলা, ও-হেলা কাহারে বাজে!

হয়ত গোপনে ব্রজের গোপাল এসেছে রাখাল সাজে!

                  চাষা বলে কর ঘৃণা!



দেখো চাষা-রূপে লুকায়ে জনক বলরাম এলো কি না!

যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তারাও ধরিল হাল,

তারাই আনিল অমর বাণী-যা আছে রবে চিরকাল।

দ্বারে গালি খেয়ে ফিরে যায় নিতি ভিখারী ও ভিখারিনী,

তারি মাঝে কবে এলো ভোলা-নাথ গিরিজায়া, তা কি চিনি!

তোমার ভোগের হ্রাস হয় পাছে ভিক্ষা-মুষ্টি দিলে,

দ্বারী দিয়ে তাই মার দিয়ে তুমি দেবতারে খেদাইলে।

                        সে মার রহিল জমা-

কে জানে তোমায় লাঞ্ছিতা দেবী করিয়াছে কিনা ক্ষমা!

বন্ধু, তোমার বুক-ভরা লোভ, দু’চোখে স্বার্থ-ঠুলি,

নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হ’য়েছে কুলি।

মানুষের বুকে যেটুকু দেবতা, বেদনা-মথিত-সুধা,

তাই লুটে তুমি খাবে পশু? তুমি তা দিয়ে মিটাবে ক্ষুধা?

তোমার ক্ষুধার আহার তোমার মন্দোদরীই জানে

তোমার মৃত্যু-বাণ আছে তব প্রাসাদের কোনোখানে!

                        তোমারি কামনা-রানি

যুগে যুগে, পশু, ফেলেছে তোমায় মৃত্যু-বিবরে টানি।



মানুষ কবিতার মূলভাব 


মানুষ কবিতা কবি তুলে ধরেছেন পৃথিবীতে আমরা সবাই মানুষ মানুষকে মানুষের কোন ভেদাভেদ থাকতে পারে না। যে কোন ধর্মের যে কোন বর্ণের যে কোন গোত্রের সবার বড় পরিচয় হচ্ছে আমরা মানুষ। 


কিন্তু মানুষ কবিতায় ক্ষুধার্ত ব্যক্তিটি মন্দিরের পূজারীরা এবং মসজিদের মোল্লা দাঁড়া অবহেলিত বাঁ নিগৃহীত  হয়েছে। অথচ ৮০ বছর ধরে কোনো প্রার্থনা ছাড়াই সে প্রভুর দেওয়া খাবার খেয়ে বেঁচে রয়েছে।


মানুষের সম্মান, মর্যাদা এবং উচ্চাসন সবকিছুই স্রষ্টার কাছে সমানই।অথচ মানুষ একে অপরকে ধর্মের নামে এবং জাতের নামে ভিন্ন ভিন্ন করে দেখেন।আমাদের সমাজে মসজিদে মন্দিরে পুরোহিত মোল্লার আধিপত্য চলে। 


ভজনালয় খোদার ঘরে কপাট লাগিয়ে যারা তালা দিয়ে থাকে তারা মানবতার বা মানুষের শত্রু, তারা সাম্যের শত্রু। তাদের প্রতিহত করতে সাধারণ মানুষ একদিন হাতুড়ে,শাপল নিয়ে অবশ্যই এগিয়ে যাবে।আর এর ফলে আমাদের জগতে মানবতার জয়ের স্লোগান উঠবে। তাই কখনো মানুষ হয়ে মানুষকে ঘৃণা করা যাবে না এবং কাউকে ছোট করে দেখা যাবেনা এইটাই বোঝাতে চেয়েছে আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই মানুষ কবিতা এর মাধ্যমে। 


Akash

প্রযুক্তির খবর, শিক্ষা ও ইন্সুরেন্স, ভিসার খবর, স্বাস্থ্য টিপস ও অনলাইনে আয় সম্পর্কিত তথ্যের বিরাট একটি প্ল্যাটফর্ম।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post